Miran Mizan
সকলের জীবনেই মাঝে মাঝে এমন একটি নাটকীয় মুহূর্ত আসিয়া উপস্থিত হয় যে, সমস্ত হিসাব, সমস্ত আয়োজন হঠাৎ নিমেষে বদলাইয়া যায়। উত্তরবাহিনী নদিস্রোত সহসা দক্ষিণী বাহিনী হইয়া পড়ে, তুঙ্গ পর্বত অকস্মাৎ গভীর গহ্বরে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের জীবনেই এইসব হয়। ইহার জন্য রাম বা রাবন হওয়ার প্রয়োজন নাই। নকুল নন্দী সাধারণ লোক, তার পুত্র গোকুলও অসাধারণ কিছু নহে। আর পাঁচজনের মতো সেও বি. এ. পাশ করিয়া ওখানে আড্ডা দিয়া, তাস খেলিয়া, শখের থিয়েটারে অভিনয় করিয়া রাজনীতি অথবা সাহিত্য সম্পর্কে মাথা ঘামায় অৰ্থাৎ এককথায় ভ্যারেন্ডা ভাজিয়া দিন যাপন করিতেছিল। আর পাঁচজনের যেমন বিবাহের সম্বন্ধ আসে, গোকুলের তেমনই আসিতে লাগিল।
বিবাহের বাজারে গোকুল সুপাত্র। শহরের উপর একখানি ত্রিতল বাড়ি, পিতার তেজারতির ব্যাবসা, মাতুলের বিষয় সম্পত্তি যাহা আছে, তাহাতে কোনকালে গোকুলকে উদরাণ্যের জন্য চাকুরীর উপর নির্ভর করিতে হইবে না। ভগবান তাহাকে যাহা দিয়াছেন তাহাতে স্বাচ্ছন্দে সে সারাজীবন শখের থিয়েটার রিজিয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নাট্য শিল্পের উৎকর্ষ বিধান করিতে পারে। বিবাহের সম্বন্ধ আসিতে লাগিল। পিতা নকুল নন্দী অভিজ্ঞ লোক। কুষ্ঠী, বংশ, পাত্রীর রূপ, পনের পরিমাণ সমস্ত দিক বিচার করিয়া নন্দী মহাশয় যে পাত্রীটিকে মনোনীত করিলেন, তাহার ডাক নাম তিলু, ভাল নাম তিলোত্তমা। নন্দী মহাশয় সেকেলে লোক, সুতরাং পুত্রকে না পাঠাইয়া নিজেই কন্যাকে দেখিতে গেলেন এবং পছন্দ করিয়া আসিলেন। নাম শুনিয়া গোকুল মুগ্ধ হইয়া গেল। মনে মনে সে যে ছবিটি আকিতে লাগিল, কাব্যের তিলোত্তমা তাহার কাছে কিছু নয়।
শুভদৃষ্টির সময় সে ঘাবরাইয়া গেল। তিলোত্তমাই বটে। তিলের মতোই কুচকুচে কালো এবং গোল। ছোট ছোট চোখে ভীরু শংকিত দৃষ্টি। উলুধ্বনি, সংখধনী, কোলাহলধ্বনি, পরিবেশনধ্বনি, না না রূপ ধ্বনির মধ্যে ইহারই পানিপীরণ তাহাকে করিতে হইল। উপায় নাই, কিন্তু ঘাবরাইয়া গেল। পিতা নকুল নন্দিও ঘাবরাইয়া গেলেন। তিনি বেহাইটিকে যেরূপ সোজা লোক মনে করিয়াছিলেন, দেখিলেন আসলে তিনি মোটেই সেইরূপ সোজা নহেন। লোকটা হাত কচলাইয়া ক্রমাগত হে-হে-হে-হে- করিয়া চলিয়াছে, অথচ একটিও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই। নগদ পাঁচশত টাকা পন কম দিয়াছে, বলিতেছে, এখন সব জুটাইতে পারা গেল না, বাকি টাকা পরে পরিশোধ করিয়া দিব। দান পত্র দিয়াছে, অত্যন্ত খেলো।
চেলির রং উঠিয়া যাইতেছে। রিস্ট ওয়াচ নাই- কলিকাতায় নাকি অর্ডার দেওয়া হইয়াছে, এখনও আসিয়া পৌঁছায় নাই। আংটিটা সোনার কিনা কে জানে- দেখিতে তো পিতলের মতো। তিনি শেষে একটা ধরিবাজের সহিতই কুটুম্বিতা করিয়া বসিলেন নাকি? তখন তিনি যাহা যাহা দাবি করিয়াছিলেন- লোকটা তাহাতেই রাজি হইয়া হাত কচলাইতে কচলাইতে ঘাড় নাড়িয়া ছিল। দাবি অবশ্য তিনি একটু বেশিই করিয়াছিলেন, কিন্তু বেশি টাকা না পাইলে ওই কুচ্ছিত হাদামুখো মেটো মেয়েকে পুত্রবধূ রূপে বরণ করিয়া লইবেনই বা কেন তিনি? সব জিনিসের একটা হিসাব আছে তো! কিন্তু একি কান্ড? ওই অতিবিনয়ী লোকটার নিকট এ ব্যাবহার কে প্রত্যাশা করিয়াছিল। বাড়িতেও গাল খাইতে হইল। গোকুলের মা উচ্চকণ্ঠে এই কথাই বার বার বিঘোষিত করিতে লাগিলেন যে নকুলের ভীমরতি ধরিয়াছে। তাহা না হইলে কেহ সজ্ঞানে নিজ পুত্রের জন্য ওই পেত্নীকে বউ করিয়া আনিতে পারে? ছি ছি ছি ছি! নকুল মিথ্যা কথা বলিয়াই রেহাই পাইলেন- ও মেয়ে আমায় দেখায়নি, আমি যে মেয়ে দেখেছিলাম, তার টকটকে রঙ, একপিঠ চুল, দিব্যি চোখমুখ, গোলগাল গড়ন। চোর- চোর, জোচ্চোর, ধরিবাজ ব্যাটা। ছেলের আমি আবার বিয়ে দেব। সকলেই ইহাতে সায় দিল। এমনকি গোকুল পর্যন্ত।
তিলোত্তমার সহিত আলাপ হইলো বইকি। একটা জিনিস গোকুল লক্ষ না করিয়া পারিল না, তিলু ভারী ভালো মানুষ। মুক্তকেশী বেগুনের মতো মুখখানিতে ভালমানুষি যেন মাখানো। লাজুক ও খুব। অনেক সাধ্য সাধনা করিয়া তাহার সহিত আলাপ করিতে হইয়াছে। আলাপ করিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। তাহার বাবাকে সকলে মিলিয়া এত গালাগালি দিলো, তাহাতে তাহার ভ্রূক্ষেপ মাত্র নাই। সকালে সূর্য উঠিলে বা বর্ষা কালে বৃষ্টি নামিলে সে বিস্মিত বা বিচলিত হয়না। এ ব্যাপারেই হইল না। বিবাহের ব্যাপারে এসব হইয়া থাকে, ইহাতে আশ্চর্য বা দুঃখিত হইবার কিছু নাই। নকুল নন্দী তাহার সম্পর্কে যে মিথ্যাভাষণ করিয়াছিলেন, ইচ্ছা করিলে সে তাহার প্রতিবাদ করিতে পারিত। কিন্তু সে করিল না। সসঙ্কোচে চুপ করিয়া রহিল। গোকুলকে স্বামী রূপে পাইয়া সে কৃতার্থ হইয়া গিয়াছে, অকারণ বাদ-প্রতিবাদে প্রয়োজন কি? সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করিতেছে, সে গোকুলের অনুপযুক্ত। অনধিকারী হইয়াও সে ভাগ্যবলে সুখস্বর্গে প্রবেশ করিয়াছে।
কলহ-কোলাহল ভুলিয়া এ আনন্দলোক হইতে নির্বাসিত হইতে সে চায় না। গোকুল বলিল, বাবা-মা বলছেন, আমার বিয়ে দেবেন। তিলু চুপ করিয়া রহিল। উত্তর দিচ্ছ না যে? বেশ তো, হিন্দুর ঘরে হয় তো অমন। তোমার কষ্ট হবে না? আমার? না। একটু চুপ করিয়া পুনরায় কহিল, হলেও তোমার যদি তাতে সুখ হয়, সে কষ্ট সহ্য করব। গোকুলের মনে হইল, ইহা অভিমানের কথা। কিছু বলিল না। বছর খানেক কাটিয়া গেল। তিলুর সমন্ধে মোহ-মুক্তি হইবার পক্ষে এক বৎসর যথেষ্ট সময়। না জানে লেখাপড়া না জানে গান বাজনা, না জানে হাবভাব। না আছে রূপ না আছে গুন। গুনের মধ্যে মহিষের মতো খাটিতে পারে। কারি কারি বাসন মাজিয়া চলিয়াছে। রাশি রাশি কাপড় কাঁচিয়া চলিয়াছে, ভ্রূক্ষেপ নাই। মা তাহাকে রান্না ঘরে ঢুকিতে দেন না। সে বাহিরের কাজ কর্ম লইয়া থাকে, এবং তাহাতে ডুবিয়া থাকে। আকাশে চাঁদ উঠিল কিনা, বকুল বনে পাপিয়া ডাকিলো কিনা, এ সবের খোঁজ রাখা তাহার সাধ্যাতীত। নাট্যশিল্পী কবি প্রকৃতির গোকুল দমিয়া গেল এবং অবশেষে হাল ছাড়িয়া দিল। একটা চাকরানীর সহিত কাহাতক আর প্রেম করা যায়। বাবা যদিও এখনও বেহাই-গুষ্টির উপর চটিয়া আছেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিবাহের কথা তিনি আর উত্থাপন করেন না। স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া গোকুলের পক্ষেও মুখ ফুটিয়া সে প্রস্তাব করা শক্ত। এমন সময় বিধাতা একদিন মুখ তুলিয়া চাহিলেন।